বাভারিয়ায় ব্যাকপ্যাকিং এর গল্প প্রথম পর্ব

বাভারিয়ায় ব্যাকপ্যাকিং এর গল্প প্রথম পর্ব
Post Series: ভ্রমন গল্প

Sharing is caring!

খুব সম্ভবত বাভারিয়া নাম টা প্রথম শুনি শার্লক হোমসের একটা এপিসোডে। এরপর আরো অনেক বার বাভারিয়ার নাম শুনেছি। আমার কাছে ইউরোপ মানে ভিয়েনা, প্রাগ মিউনিখ এসব ছিল। কখনোই সুইজারল্যান্ড বা প্যারিস এসব টানে নি আমাকে।

প্যারিস থেকে ১৮ মে রাতে রওনা দিলাম বাসে। প্রায় ৯০০ কি.মি রাস্তা ১২ ঘন্টা মত বাসে লাগে। ইউরোপের বাস আমাদের লোকাল বাসের মত। কোনভাবেই কমফোর্টোবল না। এক্সপেরিয়েন্স অনেকটা আমাদের আন্তনগর ট্রেনের মত। মানে সিট এমনই ঝাকুনি ও ট্রেনের মত। আবার ট্রেনে বসলে প্লেনের মত ফিল পাওয়া যায় কখনোই চলার সময় তেমন ঝাকুনি নাই।

বাস চলে ৮০-১০০ কি.মি স্পিডে আর ফাঁকা রাস্তা। আমাদের এনা বা হানিফের ড্রাইভার কে বসায় দিলে ৯০০ কি.মি রাস্তা ৩ ঘন্টাতে নিয়ে যাইতে পারবে। পুরা ইউরোপে জার্মানির রোড মনে হল সবথেকে বেষ্ট। রাস্তা ভাঙাচোরা না থাকলেও বাম্প করে। যখনি প্যারিসের টেরিটোরি ছেড়ে জার্মানিতে ঢুকলাম এমনিতেই বোঝা গেল যে ঢুকে গেছি জার্মানি তে। মানে টুকটাক যে ঝাঁকুনি ছিল সেটাও নেই।

মিউনিখে এসে পৌছুলাম সকাল ৮.৩০ এর দিকে খুব সম্ভবত। ঢোকার পর থেকে কেমন জানি মনে হল ডেড একটা শহরে চলে এসেছি। প্যারিসের মত হ্যাপেনিং প্রানবন্ত একটা শহর ছেড়ে এমন একটা জায়গাতে আসা বেশ অড। মনে হচ্ছিল শহরে কিছু তো একটা হয়েছে বিশাল রাস্তাঘাট ফাঁকা, দোকানপাট ও বন্ধ। ভাবলাম হয়তো এমন ই হবে মিউনিখ।

বাস স্টপ থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা দুরত্বে আমার হোস্টেল। নেমে হাঁটা শুরু করলাম। ইউরোপে আসার আগে অন্যরকম একটা নার্ভাসনেস কাজ করতো সবসময়। এত উন্নত দেশে যাচ্ছি পথে ঘাটে চলতে পারবো কিনা। রাস্তা হারায়ে ফেলবো নাকি আবার ইউরোপীয়ান রা বেশ নাক উঁচু ইংলিশে কথা বলেনা শুনে এসেছি। বিশেষ করে জার্মান রা। তবে গত ৩ দিনে প্যারিস ফ্রাঙ্কফুর্ট ঘুরে ভয় টা দুর হয়ে গেছে অনেকটা। খুব অল্প সময়ে রাস্তাঘাট, মেট্রো সবে চলাচল করার ব্যাপার গুলো আয়ত্ত করে ফেলেছি।

হোস্টেলে যাবার পথে একটা টানেল পড়ে। টানেল দেখে হলিউড মুভির কথা মনে পড়লো। আকাম কুকাম এমন সব জায়গাতে হয়। বাইরে আলো থাকলেও ভিতরটা কিছুটা অন্ধকার অপর পাশে আলো দেখা যায়। গাড়ি ও খুব কম চলাফেরা করছে। স্যাঁতসেতে একটা ভাব আছে আর কিছুটা উটকো গন্ধ ও। ৫/৬ মিনিট হেঁটে বের হলাম, ভাগ্যিস কোন ড্রাগ এডিক্ট বসে ছিল না টানেলের পাশে ?।

কিছুটা পথ হেঁটেই দেখি মিউনিখের সেন্ট্রাল ট্রেন স্টেশন৷ কিছুটা পথ পার হয়েই হাতের ডানের রাস্তায় আমার হোস্টেল। ইউরোপে বেশিরভাগ হোস্টেলের চেকইন টাইম দুপুর ২/৩ টার দিকে আর চেকআউট আবার সকাল ১১ টা। সবাই আর্লি চেকইন এলাউ করেনা। বিশাল বড় কমন স্পেস পাশে বার এরপর রিসিপশন। বললাম বুকিং আছে, সব চেক করে বললো তোমার অপেক্ষা করতে হবে এখনো রুম রেডি না। বললো তুমি লকারে ব্যাগ রেখে ঘুরতে পারো আর ১ টা তে এসে চেকইন করতে পারবে।

বসে বসে আগেরদিনের কিনে আনা ম্যাকরন খেয়ে শেষ করলাম। খাবার পানি শেষ গিয়ে ওয়াশরুমে রিফিল করলাম বোতল সাথে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ইউরোপে বাথরুমের ট্যাপ থেকেও পানি খাওয়া যায়।যথেষ্ট অড আর রুচির ব্যাপার জিনিষটা। যদি রুচির এত ব্যাপার থাকে স্পার্কলিং ওয়াটার খেতে গিয়ে ফকির হতে হবে। ১ লিটারের বোতল ২-৩ ইউরো সে হিসাবে দিনে ৮-১০ ইউরো পানিতেই যাবে। ইউরোপিয়ান রা ১ বোতল পানি আর ২-৩ ক্যান বিয়ার কিনে। সুপারশপে বিয়ার সস্তা পানির থেকে। বিয়ার এর গল্পে পরে আসছি।

ফ্রেশ হয়ে বসে নেট সার্ফিং শরু করলাম। মিউনিখে দেখার কি কি আছে। প্ল্যানিং কিছুই করিনি, মিউনিখে ৩ দিন থাকবো একদিন যাব ক্যাসেল দেখতে আর বাকি কিছু জানিনা। নয়েশোনেষ্টাইন ক্যাসেল দেখতেই মিউনিখে আসা। বসে বসে দেখছি কি করা যায় এর মধ্যে এক মেয়ে এসে লোকজন রেডি করছে ফ্রি ওয়াকিং ট্যুর। সব মেজর সিটিতে এমন ওয়াকিং ট্যুর হয়। যেগুলো ফ্রি কিন্তু শেষে গাইড কে ৫-১০/১৫ ইউরো টিপ দিতে হয়। ডিপেন্ড করে কত লম্বা ট্যুর। ফ্রি কিন্তু ফ্রি না, না দিলেও জোর নাই। তবে এসব ট্যুরে গেলে শহর সম্পর্কে অনেক গভির ভাবে জানা যায়।

সেই মেয়েকে বললাম আমি যেতে চাই। বললো ১০ মিনিটের মধ্যে রেডি হও, ১১ টা সময় মারিয়েনপ্লাজ থেকে শুরু হবে ট্যুর। ব্যাগ লকারে রেখে গেলাম সে মেয়ের সাথে। আমার হোস্টেল থেকে আর ২-৩ জন মত জয়েন করলো। যেতে যেতে সে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা চারিদিক এমন ডেড সাইলেন্স কেন? কোন সমস্যা চলছে শহরে? সে অবাক হয়ে বলো দিস ইজ বাভারিয়া আর আজ সানডে এর মানে হলে কোন কাজ নাই। সবকিছু সানডে তে বন্ধ এখানে এমনকি সুপারস্টোর গুলো ও বন্ধ। শুধু রেস্টুরেন্ট খোলা পাবা। এটা নতুন ছিল আমার কাছে, শুক্রবার অফ ডে হলেও প্রায় সবই খোলা থাকে দেশে।

মারিয়েনপ্লাজ

মারিয়েনপ্লাজ হল মিউনিখের প্রানকেন্দ্র বা সিটি সেন্টার বলা চলে। ইউরোপের প্রতিটা শহরে এমন কিছু জিরোপয়েন্ট আছে যেখান থেকে ওয়াকিং ট্যুর বা বিশেষ ইভেন্ট গুলো হয়। গিয়ে দেখি প্রচুর লোক ভিড় করে দাড়িয়ে আছে ছোট্ট কমপ্লেক্স টা তে। সবাই একটা পুরান বিল্ডিং এর দিকে তাকিয়ে। বিল্ডিং এর একদম উপরে কিছু পুতুল সাজানো আছে। রোজ ১১ টা ১২ টা আর বিকাল ৫ টা তে খুব সম্ভবত পাপেট শো হয় একটা। শো তে প্রথমে বাভারিয়ার ইতিহাসের সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিয়ে দেখানো হয় এবং দ্বিতীয় ধাপে দেখানো হয় কুপারস ড্যান্স। ১৫১৭ সালে মিউনিখে প্লেগ হয় একটা তারপর থেকে একটা মিথ চালু হয় রাস্তায় একটা সার্টেইন ড্যান্স স্টেপ এ নাচতে হবে। এরপর থেকে এটা বাভারিয়ার কালচারে এড হয় প্রতি ৭ বছর পরপর এটা বাভারিয়া আর এর আশপাশের এরিয়াতে হয়। সবশেষ টা এবছর আমার যাবার কিছুদিন আগে ছিল আমাদের গাইড বললো। এটা শুনে যে আফসোস লাগলো বলে বোঝানো যাবেনা।

ইউরোপের টপ ৫ দেখার জিনিষের একটা নাকি এই পাপেট শো। গাইড বলার পর এটেনশন দিলাম। সে একটু ফান টাইপ ছিল, বলে একটুপর তোমরা সবাই ফোন বের করে ভিডিও করবো কিন্ত কোন লাভ নাই ইউটিউবে এই ভিডিও ভুরি ভুরি বেটার এনজয় কর। আমি ৩০ সেকেন্ড করে বন্ধ করে দিলাম।

এরপর সে আমাদের বিশাল গ্রুপ কে নিজের পরিচয় দিল তারপর ট্যুর কিভাবে কতক্ষন হবে বললো। প্রথমেই একটা চার্চে নিয়ে গেল। যেতে যেতে বললো মিউনিখের পুরা শহরের উপর ইতালিয়ান ইনফ্লুয়েন্স আছে। বাড়ি ঘর থেকে শুরু করে সবকিছুতেই। মিউনিখের মানুষ হাতে কাপাচিনো নিয়ে বারান্দায় বসে থাকতে ভালবাসে। সাউথের ইতালি ও বলা হয় একে। যে চার্চে নিয়ে গেল সেটা যখন বানানো শুরু করে তখন টাকা পয়সার ঘাটতি হয়। তখন যে বানায় সে শয়তানের কাছে হেল্প চায়, শয়তান তাকে শর্ত দেয় যে সে সাহায্য করবে কিন্তু চার্চে কোন জানালা থাকা যাবেনা। তাই চার্চে কোন জানালা নেই। তবে পরবর্তীতে শেষ করার সময় নাকি কিছু জানালা এড করা হয়। এতে শয়তান খুন্ন হয়ে পা দিয়ে চার্চের গ্রাউন্ডে আঘাত করে। চার্চের মেঝের একটা জায়গাতে এখনো সে ক্র্যাক আছে।

বাকি জার্মানির চেয়ে বাভারিয়ার মানুষ বেশ ধার্মিক বলা চলে। বাভারিয়াতে না মিউনিখে ১৪০০ চার্চ আছে আমাদের গাইড বললো। তবে এটা শিউর বলতে পারছিনা। চার্চ থেকে বের হয়ে শুরু হল বিয়ার কথন। বিয়ারের আবিষ্কার হবার গল্পটা ছিল ভিন্ন। আগে পরিষ্কার খাবার পানি মিলতো না। তখন বিভিন্ন মনেষ্ট্রির মংক বা সোজা বাংলায় মন্দিরের পন্ডিত। তবে এই মংক আবার বুদ্ধিষ্ট মংক না। এরা বার্লি দিয়ে বিয়ার বানানো শুরু করলে আর বিয়ার ছিল পানির থেকে বিশুদ্ধ পানীয়। এরা পরিষ্কার পানির অভাব বিয়ার দিয়ে পুরন করতো আর সারাদিন মাতাল থেকে ধ্যান করতো।

এখনো এমন অনেক মনেষ্ট্রি আছে যেখানে এমন বিয়ার বানানো মংক আছে৷ সেগুলোতে দিয়ে বিয়ার বানানোর প্রসেস আর টেষ্ট ও করা যায়। মিউনিখ থেকে ডে ট্রিপে নিয়ে যায় বিভিন্ন ট্যুর কোম্পানী। বিয়ার নিয়ে মিউনিখে সবচে পরিচিত যে নাম সেটা হল হফব্রাহস ব্রিউয়ারি। এই বিয়ার হাউস এর ফাউন্ডার হল সেই ডিউক যার বিয়ে মারিয়েনপ্লাজ এ দেখানো হয়৷ ডিউকের নাকি কোন বিউয়ারির বিয়ার ভাল লাগেনি। তাই সে নিজের রেসিপিতে নতুন বিয়ার আনে। আর এটা অনেক দীর্ঘসময় ধরে রয়্যাল বিয়ার ছিল। সাধারন মানুষজন এটা টেষ্ট করার জন্য মুখিয়ে ছিল। প্রথম রয়্যাল বিয়ার টেষ্ট করার গল্প টাও ভিন্ন ছিল।

মিউনিখ ন্যাশনাল থিয়েটার

মিউনিখ ন্যাশনাল থিয়েটারের কারণে মানুষজন এই বিয়ারের স্বাদ প্রথমবার পায়। তিনবার এই ন্যাশনাল থিয়েটার বানানো হয়৷ প্রথমবার টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে যায় কন্সট্রাকশন তারপর সেটাতে আগুন ধরে। আবার কাঠ ব্যবহার করেই বানানো হয়। একটা পারফর্মেন্সের সময় আবার আগুন ধরে তখন পানির লাইন সব জমে গেছিল শীতে। সে সময় সবচে কাছে ছিল হফব্রাহস এর বিয়ার হল। সেখান থেকে বিয়ারের ব্যারেল আনা হয় আগুন নেভানোর জন্য। তখন হফব্রাহস থেকে ন্যাশনাল থিয়েটার পর্যন্ত মানুষ লাইন ধরে বিয়ার হাতে হাতে পাঠায় আগুন নেভাতে। এই সুযোগেই সবাই প্রথম রয়্যাল বিয়ারের স্বাদ পায়। লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় পানির বদলে বিয়ার বার বার কাজে এসেছে।

হফব্রাহস এর বিয়ার হল এখন পাবলিকের জন্য ওপেন। তবে এই বিয়ার হলে এখনো অনেকে রিজার্ভ সিট আছে যেখানে কেউ বসতে পারেনা। আর সবার নিজের বিয়ারের মগ আছে আবার সে মগ রাখার আলাদা লকার সিস্টেম ও আছে। এরকম মেম্বার হতে চাইলে অনেক লম্বা সময় ধরে এখানে বিয়ার খেতে হবে তারপর বাৎসরিক কিছু ফি ও আছে।

বিয়ার গার্ডেন

মিউনিখের ৬ টা মেজর বিয়ার হাউস আছে। যাদের বলা হয় বিগ সিক্স। এই বিগ সিক্স পুরা মিউনিখের মালিক বলা চলে। মিউনিখের যত বিল্ডিং বাড়িঘর দোকানপাট সবই বলা চলে কোন না কোন বিয়ারহাউসের অধিনে। কোন বিল্ডিং বা দোকান বা রেস্টুরেন্ট যদি কোন বিয়ারহাউসের আন্ডারে হয় তবে তাকে অবশ্যই সে বিয়ারহাউসের সিম্বল বা পতাকা লাগাতে হবে। অনেকটা মনোপলি বিজনেস এর মত ব্যাপার স্যাপার।

এই বিগ সিক্স ছাড়াও মিউনিখ জুড়ে অসংখ্য মাইক্রো ব্রিউয়ারি আছে। পুরা দুনিয়ার ৬ ভাগের ১ ভাগ বিয়ার বাভারিয়া প্রডিউস করে। বিয়ার নিয়ে সবচেয়ে বড় ফেস্টিভ্যাল অক্টোবর ফেস্ট ও হয় মিউনিখে। এটার পিছনেও গল্প হল ১৮১০ এ প্রথম কিং লুডউইগ এর বিয়ে। তার বিয়েতে সিটি গেইটের সামনে সবাইকে দাওয়াত করা হয়। বিশাল আয়োজন আর আনলিমিটেড বিয়ার তো আছেই৷ বাভারিয়ার মানুষজন বিয়ার খাবার ছুতো খুঁজে। এরপর থেকেই এই বিয়ের সেলিব্রেশন কে ধরে প্রতিবছর অক্টোবর ফেস্ট হয়। মিড সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের ফার্স্ট উইক পর্যন্ত ১৬-১৮ দিনের এই ফেস্টিভ্যাল চলে। ৬০ লাখ মানুষ প্রতিবছর আসে এই ফেস্টিভ্যালে৷ পানির মত বিয়ার খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকে আসলে।

এরপর বেশ কিছু হল মিউজিয়াম বিয়ার গার্ডেন ঘুরিয়ে দেখালো। ইউরোপিয়ান রা যতই উন্নত হোক তারাও কম কুসংস্কারাচ্ছন্ন না কিন্তু। সেটা বুঝলাম রাস্তায় যেতে যেতে। রাস্তার ধারে জুলিয়েটের একটা লাইফ সাইজ ব্রোঞ্জের মুর্তি আছে। সে মুর্তির লেফট ব্রেস্টে হাত বুলালে নাকি গুডলাক আসে। আমাদের গাইড এটা বলার পর বললো জুলিয়েটের বয়স ১৮ ও হয়নি তখন। এসব করে গুডলাক আসবেনা তারপরেও তোমরা সবার মত করতে পার। এমনি একটা সিংহের মুর্তির মুখে হাত বুলালেও নাকি গুডলাক আসে। এমন অসংখ্য জিনিষ পুরো ইউরোপ জুড়ে আসলে। কোন মুর্তি তে শাইনি কোন পার্ট দেখলে বুঝতে হবে মানুষ গুডলাকের জন্য টাচ করে এইটা।

ট্যুর দেখতে দেখতে প্রায় শেষের দিকে। আমি পাশেই একটা পার্কে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। এরপর গাইডের থেকে শুনলাম পাশে একটা পার্ক আছে ইংলিশ গার্ডেন খুব সুন্দর শুনেছি। আরেকটা কারণে ইংলিশ গার্ডেন ফেমাস। সেটা হল নুড পার্ক এর মধ্যে পড়ে। সামারে কাপড়চোপড় সব খুলে সানবাথ করে সবাই৷ তবে ওটা একটা নির্দিষ্ট এরিয়া তে। আমি পার্কে ঢুকে ছাঁয়া খুঁজে লেকের পাশে বসলাম। দেখি হাঁস আছে বেশ কয়টা। একটু পর হাঁস গুলো পাশে এসে রিতিমত নাচা শুরু করলো। একদমই প্রস্তুত ছিলাম না এটার জন্য। বেশ অবাক হলাম এটা দেখে। দেখতে আমাদের লোকাল হাঁস গুলোর মতই।

মিউনিখের সবচে সুন্দর পার্ক আমার দেখা। কাজ না থাকলে এখানে সারাদিন শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়া যায়৷ আমি একটা ছোটখাট ন্যাপ নিয়ে নিলাম। দুপুরে ওয়াকিং ট্যুরে গিয়ে কিছু খাওয়া হয়নি। ভাবলাম যাই খেয়ে আসি কিছু। কি খাব ভাবতে ভাবতে দেখলাম স্নিজ্জেল নামের একটা ডিশ বেশ বিখ্যাত। সবচে ফেমাস যে রেস্টুরেন্ট সেটায় গেলাম খেতে।

স্নিজেল

প্রায় ২ কি.মি দুরে রেস্টুরেন্ট টা। রিভিউ এ যেমন দেখেছি তেমন কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা। পরে দেখি রেস্টুরেন্টের সামনেই দাড়িয়ে আছি। কিন্তু কোনভাবেই যে রিভিউ ভিডিও দেখেছি তার সাথে মিলেনা। ভাবলাম ভুল জায়গাতে আসলাম কিনা। এরপর ভিতরে ঢুকলাম তখন বললাম তোমরা কি ওপেন? বলে হ্যা পিছনে গিয়ে বসতে পার। দেখলাম পিছনে বিশাল বাগান। এতক্ষনে মিলেছে, বেশ খুশি হয়ে গিয়ে ভিতরে বসলাম৷ বসে অর্ডার দিলাম স্নিজেল হর্শ‍র‌্যাডিশ ফ্লেভারের। সাথে রাইস সহ। জিজ্ঞেস করলো ড্রিংকস এ কিছু নিব কিনা। বললাম পানি দাও। এরপর বলে স্পার্কলিং পানি দিব। বললাম না ট্যাপের পানি দাও।

২০ মিনিট পর যেটা আসলো আমি রিতিমত তব্দা খেলাম। রিতিমত একটা A4 পেপারের সাইজের একটা কাটলেট টাইপের জিনিষ। বিফ কে পাতলা করে কেটে ব্রেডক্রাম্ব ডিমে ডুবিয়ে ভেজে বানায় এটা। শুরু করলাম খাওয়া। আধাঘন্টা ধরে কোনরকমে অর্ধেক শেষ করতে পারলাম। সারাদিন না খেয়ে এক ক্ষুধা পাইসিল অথচ অর্ধেকের পর আর কোনভাবেই গিলতে পারছিনা। তারপরেও চেষ্টা করছি খেতে। আমার পাশে কিছু জার্মান বসলো তারা দেখি বেশ কয়টা ডিশ অর্ডার করলো সাথে বিশাল সাইজের মগে করে বিয়ার।

দেখি ওরাও স্নিজেল অর্ডার করলো সাথে একজন দেখি বিশাল সাইজের আলু সেদ্ধ তার উপর গ্রেভি দিয়ে কি একটা ডিশ অর্ডার দিয়েছে। বড়ই অদ্ভুত বাভারিয়ান ডিশ। ওরা ১৫ মিনিটে গল্প করতে করতে ১ লিটার মগের বিয়ার সাথে স্নিজেল শেষ। আমি ৪৫ মিনিট ধরে খেয়েও ১ কোয়ার্টারের বেশি থেকে গেল। আর সম্ভব না। বললাম বিল করে দাও। এরপর বিল দিয়ে বের হয়ে চলে আসলাম।

অগাস্টিনার কেলার

ভাবলাম রুমে গিয়ে একটা হটশাওয়ার নিয়ে যাব ফেমাস অগাস্টিনার কেলারে ল্যাগার বিয়ার খেতে। হোস্টেলে ঢোকার আগে আগে মনে হল ক্ষুধা লেগে গেল। কমন স্পেসে বসে কিছুক্ষণ কয়েকজনের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে জানলাম এখানে কেউই খাবার শেষ করতে পারেনা। বাভারিয়ার সার্ভিং সাইজ অনেক বড়। এটা শুনে আফসোস হল। আমি লেফটওভার টা এনে রাতে খেতে পারতাম ডিনারের খরচ বেঁচে যেত।

চেকইন করলাম হোস্টেলে৷ রুমে গিয়ে দেখলাম পুরা এলাহি কারবার। ইউরোপীয়ান ক্লাসের হোস্টেল যেমন হয়৷ মিউনিখে সবচেয়ে সস্তা হোস্টেল এত ভাল হলে এক্সপেনসিভ গুলো কেমন হবে ভাবছি। প্যারিসের হোস্টেল এত ভাল অর্গানাইজড আর পরিষ্কার ছিল না। গোসুল করে ফ্রেশ হয়ে বের হলাম। গন্তব্য অগাস্টিনার কেলার। গাইড বললো মিউনিখের সবচে পুরাতন বিয়ার গার্ডেন আর এদের হেলেস বিয়ার টা ভাল।

প্রায় ২০ মিনিট হাঁটা দুরত্বে সকালে যে বাস স্টপে নেমেছি তার পাশেই৷ সারাদিন আবহাওয়া ভাল ছিল, বের হবার পর ই দেখি অল্প গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ইউরোপের বৃষ্টির প্যাটার্ন ও ভিন্ন। ভিজে যাচ্ছি না তেমন মনে হচ্ছে৷ যাইহোক গেলাম যতক্ষণে পৌছুলাম দেখি অন্ধকার নেমে এসেছে। বাইরে বিশাল বিয়ার গার্ডেন আর পিছনে একটা পুরানো বিল্ডিং। বৃষ্টির কারণে বা যে কারণেই হোক বাইরের সব ক্লোজিং চলছে মনে হল।

একটু নার্ভাস লাগছিল, ভিতরে ঢুকতেই বেশ পুরাতন একটা ভাইব পেলাম। ভিতরে ঢুকে আমি হতবিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে আছি। এতে একজন এসে জিজ্ঞেস করলো কজন আছ।

অগাস্টিনার কেলার

বললাম আমি একা, সে বুঝতে পেরেছে একটু নার্ভাস আমি৷ বললো তুমি বস আমি ইংলিশ মেনু এনে দিচ্ছি৷ সেখানে দেখি সব ওয়েটার রা ট্রেডিশনাল বাভারিয়ান ড্রেস পড়ে সার্ভ করছে। আমি মেনু নেড়েচেড়ে দেখছি। সকালে গাইড বলেছিল অগাস্টিনার এর হেলেস ল্যাগার বিয়ার ভাল৷ তারপর সে বললো হেলেস মানে এভিল বা নরকিয় কিছু না এটা মানে হল লাইট বা হলদেটে রঙের এটা একটা বিশেষত্ব বাভারিয়ার বিয়ারের। ওয়েটার আসলো বললাম বিয়ার ট্রাই করবো। সে তখন কোনটা কেমন এক্সপ্লেইন করা শুরু করলো। এরপর বললো এটা নাও এটাই সবাই খায়। বললাম দাও তবে বড় মগে তখন হেসে পাশের একজনের দিকে পয়েন্ট করে বললো এমন? বললাম হ্যা।

বসে থেকে অপেক্ষা করছি এরকম মুহুর্তে দেখে বড় দুইটা কুকুর নিয়ে হাফপ্যান্ট পড়া ট্রেডিশনাল বাভারিয়ান ড্রেস আর মাথায় টুপি এক মাঝ বয়সী লোক ঢুকলো৷ এত বড় সাইজের কুকুর জন্মে দেখিনাই৷ দেখি তারে সবাই চিনে। বিয়ার বেলি যারে বলে একদম সে জিনিষটা তার আছে। রেগুলার বিয়ার খেলে বিশাল গোল সাইজের ভুড়ি হয়। আমার বিয়ার চলে আসলো, সামনে এক জার্মান বসে ছিল তারে বললাম একটা ছবি তুলে দাও। সে ছবি তুলে দিল তারপর তার হাতের বিয়ার উঠিয়ে বললো চিয়ার্স।

এর আগে কয়েকবার বিয়ার খাবার অভিজ্ঞতা আছে। বাভারিয়ান বিয়ার মোটেও খারাপ না। মানে নরমালি বিয়ার একটু তিতা হয়, এই বিয়ারে একটা মিষ্টি স্বাদ আছে। শেষ করে বেরুবো দেখি বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। আটকা পড়ে গেলাম বুঝি। ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করে মনে হল এ বৃষ্টি থামবার নয়। এরপর দৌড়ে রওনা দিলাম। মাথায় হালকা ঝিমুনি দিচ্ছিল বিয়ারের ইফেক্ট বলা যায়। হোস্টেল পর্যন্ত দৌড়ায়ে গিয়ে সেটা ঠিক হয়ে গেল।

বেশ রাত হয়েছে তবে অন্ধকার হয়নি তেমন। ভাবলাম ঘুম দেই আজকে বেশ ধকল গেল তাছাড়া কালকে ক্যাসেল দেখতে যাব এনার্জি দরকার। এরপর বেশ লম্বা ঘুম দিলাম পরদিনের কথা ভাবতে ভাবতে।

Facebook Comments