বাভারিয়ায় ব্যাকপ্যাকিং এর গল্প দ্বিতীয় পর্ব

বাভারিয়ায় ব্যাকপ্যাকিং এর গল্প দ্বিতীয় পর্ব
Post Series: ভ্রমন গল্প

Sharing is caring!

Neuschwanstein Castle উচ্চারণ হয় ‘নয়াশোয়েনস্টেইন’ ক্যসেল। এটা ইউরোপের টপ ৫ ক্যাসেল এর একটা আর সবচেয়ে সুন্দর ক্যাসেল বলা হয়। ডিজনির লোগো এই ক্যাসেলের আদলে তৈরি করা। রিয়েল লাইফ ফেয়ারি টেইল ক্যাসেল বলা হয়।

অন্যান্য সব ক্যাসেলের মত ৫-৬০০ বছর পুরাতন এমন না। আনুমানিক ১৫০ বছর পুরাতন হবে। ১৮৮৬ এ রাজ লুডউইগ দ্বিতীয় এর মৃত্যুর পর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এখন প্রতিবছর ১৩ লাখ ট্যুরিস্ট যায়। সামারে প্রতিদিন ৬০০০ ট্যুরিস্ট যায় এই ক্যাসেল দেখতে। কপাল ভাল আমি সামার শুরুর আগে আগে গেছি। তখনো পার ডে হাজারখানেক মানুষ ছিল মনে হয়।

নয়াশোয়েনস্টেইন ক্যসেল

আমার ইউরোপ ট্রিপের হাইলাইট ছিল এটা বলা চলে৷ মিউনিখ যাবার পিছনে কারণ ও ছিল এই ক্যাসেল দেখা। বাভারিয়া জার্মানির মধ্যে পড়লেও পুরা জার্মানি থেকে আলাদা সবকিছু। বিশেষকরে এদের খাবারে সার্ভিস সাইজ।

মিউনিখ থেকে ১২০ কি.মি দুরে বাভারিয়ান অাল্পসের পাশে অবস্থিত এই ক্যাসেল৷ মিউনিখ থেকে সবাই ডে ট্রিপে যায়। মিউনিখ থেকে যাবার অনেক গুলো ওয়ে আছে। ফ্লিক্সবাস যায় সরাসরি, নিজে ড্রাইভ করতে পারলে কার নিয়ে যেতে পারেন আবার ট্রেন হল সুপার কনভিনিয়েন্ট।

এখানে যেতে হলে সবচে সস্তা হল বেয়ার্ন টিকেট করা। বেয়ার্ন টিকেট হল বাভারিয়ার ডে পাস। এই টিকেট দিয়ে পুরা বাভারিয়াতে ঘুরা যাবে। ২৫ ইউরো দাম এই টিকেটের একজনের জন্য। এরপর ৬ জন পর্যন্ত জনপ্রতি ৬ ইউরো করে এক্সট্রা দিয়ে যাওয়া যায়। মানে ৬ জন গেলে ৬১ ইউরো দিয়ে যাওয়া যাবে কিন্তু একা গেলে ২৫ ইউরো। পুরা ইউরোপে এই সিস্টেম। গ্রুপে ঘুরলে খরচ অনেক কম। এমনকি এক্টিভিটির টিকেট ও সস্তা পড়ে। তাই খরচ বাচাতে চাইলে পার্টনার খুঁজে যাওয়া বেটার তাহলে টিকেটের খরচ কিছুটা বাঁচানো যায়।

বৃষ্টিভেজা মিউনিখের রাস্তা

সকাল ৭ টা বাজে ঘুম থেকে উঠলাম। আজেক আবার বিশেষ দিন বলা চলে। আজকে গেম অফ থ্রোন্স এর সিজন ফাইনাল রিলিজ হবে। ডাউনলোডে দিয়ে রেখেছি, ট্রেনে যেতে যেতে দেখবো। রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ১০ মিনিট হাঁটলেই ট্রেন স্টেশন, বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সকাল ৯.৪৫ মিনিটে মিউনিখ হাপবানহপ( সেন্ট্রাল রেল স্টেশন) থেকে ট্রেন ছেড়ে যায়। জার্মানির ট্রেন অনেকটা বাংলাদেশের মত ডিলে করে।

সব কিছু নেট থেকে পড়ে নিয়েছিলাম। হোস্টেলে সকালে কাউকে পেলাম না যে ক্যাসেল দেখতে যাবে। তাহলে খরচ টা শেয়ার করা যেত বেয়ার্ন টিকেটের। যাইহোক স্টেশনে গিয়ে আবার কিছুক্ষন অপেক্ষা করলাম যদি কাউকে পেয়ে যাই। ট্রেন টা কখন তা শিওর হতে ইনফরমেশন এ গেলাম৷ এক মেয়ে বসে আছে কাউন্টারে তাকে বললাম যে ক্যাসেলে যেতে চাই। সে এরপর আর কিছু না শুনে কম্পিউটারে টাইপ করে প্রিন্ট বের করে হাতে দিয়ে দিল।

সে প্রিন্টে দেখি নেক্সট এভেইলেবল দুই তিন টা ট্রেনের ডিটেইলস দেয়া আছে। আমি এরপর গিয়ে ভেন্ডিং মেশিনের আসপাশে অপেক্ষা করছি। যে যদি কোন গ্রুপ পেয়ে যাই যারা যাবে সেদিকে তাহলে তো এড হয়ে গেলাম। সাউথইস্ট এশিয়াতে অনেকবার এভাবে টিমআপ করে বিভিন্ন জায়াগাতে ঘুরেছি। আমাকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে এক অফিসার এসে জিজ্ঞেস করলো স্যার মে আই হেল্প ইউ? অনেকটা মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মত ব্যাপার। জার্মান রা একে তো কথা বলতে চায় না তার উপর সে নিজে থেকে হেল্প করতে চাইছে। তাকে বললাম না আমি একটু ফ্রেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছি।

প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে ট্রেনের অপেক্ষা করছি

এরপর পাশে একটা বেকারি থেকে বাটার ক্রোসান্ট আর কাপাচিনো অর্ডার দিলাম। বেশ ক্ষুধা পেয়েছে সকাল সকাল। খাবার শেষ করতে করতে দেখি আর সময় নাই। শেষমেষ টিকেট টা কেটে ফেললাম।প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখি একগাদা মানুষ দাড়িয়ে আছে। সবাই এই ক্যাসেল দেখতেই যাবে। তিন ঘন্টা সময় লাগে যেতে। মিউনিখ থেকে ফুসেন নামে একটা গ্রামে পর্যন্ত যাবে ট্রেন। এরপর সেখান থেকে বাসে করে হোহেনশোয়ানগাও নামে গ্রামে যায়।

ট্রেন যথারীতি ১০ মিনিট লেট করে এল। বাংলাদেশের লোকাল ট্রেনের মত করে হুড়োহুড়ি করে উঠে গিয়েই উইন্ডো সিট দখল করলাম। ট্রেন চলতে শুরু করলো প্রথমেই চোখ আটকে গেল আশপাশের বাড়ি গুলো দেখে। যতই ট্রেন দুরে যাচ্ছে একটু গ্রামের দিকে ঢুকছি৷ ইউরোপের গ্রাম গুলো দেখার মত। বাইরে ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে আর চারিদিক স্নিগ্ধ সবুজ। মানুষজন তেমন চোখে পড়েনা। মনে মনে ভাবলাম ইশ এমন একটা জায়গাতে যদি বাড়ি বানায়ে থেকে যেতে পারতাম!

বাভারিয়ার সুন্দর গ্রাম

একটু পর দেখি একইরকম দৃশ্য। ভাবলাম অনেক লম্বা জার্নি গেম অফ থ্রোনসের সিজন ফিনালে টা শেষ করি। স্পেশাল এপিসোড স্পেশাল জার্নিতে অন্যরকম ব্যাপার। বিপত্তি বাধলো পকেটে হাত দিয়ে, ইয়ারফোন আনিনাই। তারপরেও কি করার হালকা সাউন্ড দিয়ে মুখের কাছে এনে দেখতে লাগলাম। দেখি সবাই নিজের মত গল্পে ব্যাস্ত। সব ট্যুরিস্টে ভর্তি তাই একটু হইচই টাইপ অবস্থা। নরমালি জার্মানরা বেশ চুপচাপ যতটা দেখেছি৷

ফুসেন এর আগেই একটা স্টেশনে ট্রেন থেমে গেল। সেখান থেকে নাকি বাসে যেতে হবে ফুসেন পর্যন্ত। সবাই বের হয়ে গেল, আমিও তাদের ফলো করা শুরু করলাম। এরপর একটা বাসে গিয়ে উঠলাম। শিওর না যে বাস সেদিকে যাবে। একটু উৎকন্ঠা কাজ করছিল। এরপর পাশের সিটের এক কোরিয়ান কে জিজ্ঞেস করলাম তুমি কি ক্যাসেল যাচ্ছ? সে বললো হ্যা। তারপর বললাম আমিও যাচ্ছি তবে ঠিক বাসে চড়েছি কিনা কনফিউজড ছিলাম। সে বলে আমিও শিউর না হবে আশাকরি সঠিক বাসে আছি।

আমিও আর বেশি না ভেবে বাসে বসে জার্নির মজা নিতে লাগলাম। ট্রেনের থেকে বাসের জার্নি আরো বেশি মজার মনে হল। কি সুন্দর সবুজের মাঝ দিয়ে রাস্তা। বিশাল ফাঁকা মাঠ যতদুর চোখ যায়। মাঝে মাঝে একটা দুইটা ঘর চোখে পড়ে। যেমন ইউরোপ কল্পনা করেছিলাম ঠিক তেমনই দেখছি। আসলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, মনে হয় সিনেমা দেখছি৷ প্রায় ৩০ মিনিটের জার্নি শেষে বাস এসে পৌছুলো ফুসেন এ।

ফুসেনে নেমে দেখি বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। একটা রেইনকোর্ট নিয়ে ফেললাম ভিতরের দোকান থেকে। পাহাড়ে হাইক করে উঠতে হবে, বৃষ্টি হলে কিছু করার নাই তখন বিপদে পড়বো। ভাগ্যিস রেইনকোর্ট নিয়েছিলাম, নইলে ভিজে অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। কিছুক্ষণ পর বাস আসলো আরেকটা, সবাই দৌড়ায়ে সেটাতে উঠার চেষ্টা। আমিও দৌড় দিলাম, পুরা জার্নি টা গো উইথ ফ্লো টাইপ হয়ে গেছে। বাসে ঢুকতেই ড্রাইভার টিকেট চাইলো। ট্রেনে চেক করেনি কেউ। দেখালাম আমার বেয়ার্ন টিকেট টা। এরপর একটা সিট ধরে বসে পড়লাম। ১৫-২০ মিনিট পর এসে পৌঁছুলাম হোহেনশোয়ানগাও গ্রামে।

সেখানে নেমে দেখি ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। নেমে একটু কনফিউজড যে টিকেট কাউন্টার কোথায়, বিশাল এরিয়া ট্যুরিস্ট রা ও যত্রতত্র হাঁটছে। এরপর মার্ক খুঁজে খুঁজে টিকেট কাউন্টার বের করলাম। কপাল ভাল যে জলদি এসেছি। আমি লাইনে দাড়ানোর ৫ মিনিটের মধ্যে পিছনে ৪০-৫০ জনের লাইন লেগে গেল৷

নিচের টিকেট কাউন্টার থেকে ঐযে দুরে ক্যাসেল দেখা যায়

এখানে Hohenschwangau আর Neuschwanstein দুইটা ক্যাসেল আছে। দুইটা ক্যাসেল আর মিউজিয়াম এর একটা টিকেট আছে ২৫ ইউরোর আর শুধু Neuschwanstein ক্যাসেল গেলে ১৩ ইউরোর টিকেট। স্টুডেন্ট আইডি থাকলে ১ ইউরো ডিসকাউন্ট দেয়। তাই ২৬ বছরে৷ কম বয়সী আর স্টুডেন্ট আইডি থাকলে ইউরোপে অনেক জায়গাতে এট্রাকশনে ডিসকাউন্ট মিলে৷

আমি শুধু ক্যাসেলের টিকেট কেটে উপরে যাবার প্রস্ততি নেয়া শুরু করলাম। নিচ থেকে হেঁটে যাওয়া যায় উপরে আবার ঘোড়ার গাড়িতে করেও। পুরা হ্যারি পর্টার বা ডিজনি মুভি টাইপ ফিল পাওয়া যায়। সবচে বেশি অবাক হয়েছিলাম ইউরোপীয়ান ঘোড়া দেখে। একেকটা হাতির সাইজ!

নিচে টিকেট কাউন্টারের পাশে অপেক্ষারত ঘোড়ার গাড়ি

আমি ঘোড়ার গাড়িতে যাইনি হেলেদুলে হাইক করে উঠলাম প্রায় ৩০-৩৫ মিনিট মত। প্রথমে খুঁজে পাচ্ছিলাম না কোনপথে। পরে কয়েকজন কে জিজ্ঞেস করে হাঁটা শুরু করলাম। দেশ থেকে আসার সময় খেজুর এনেছিলাম। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে আর খেজুর চিবুতে চিবুতে এগুচ্ছি। নেপালের অন্নপূর্ণা ট্রেকের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ করে। অনেকদিন হাইকিং করিনি বসে বসে খেয়েছি বলে দম ফুলে আসছে অল্পতে। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন মধ্যযুগীয় সময়ে চলে এসেছি।

উপরে উঠার সময় পাশ দিয়ে চলা ঘোড়ার গাড়ি

উপরে উঠে দেখি মানুষজন অপেক্ষা করছে। আমার টিকেটে টাইম ছিল দুপুর ১ টা তে৷ ঠিক ওই সময়েই ভিতরে ঢুকতে পাবো। আগে আগে গিয়ে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। ক্যাসেলের ভিতরে ৩০/৪৫ মিনিটের একটা গাইডেড ট্যুর হয়। ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ। আর প্রতি ৩০ মিনিট পর পর নতুন ট্যুর হয়। তাই কিউ অনেক লম্বা পড়ে। যদি পিক সিজন হয় তবে এডভান্স টিকেট না কাটলে ভিতরে ঢোকা যায়না।

একদম উপরের ওয়েটিং স্পট থেকে পুরো গ্রাম টা দেখা যায়।

বসে অপেক্ষা করছি, একটু আশপাশ ঘুরে দেখা শুরু করলাম। উপর থেকে পুরা হোহেনশোয়ানগাও গ্রাম দেখা যায়। রিতিমত একটা পাহাড়ের উপরে আছি বলা যায়। অনেক দুর থেকে গাড়ি চলাচল আর লাল টুকটুকে ছাদের ছোট ছোট বাড়ি সবুজের মাঝে। বৃষ্টির কারণে একটু ঝাপসা হয়ে আছে সবকিছু। বেশকটা ছবি তুললাম তারপর সেলফি তোলার চেষ্টা করলাম খুব ভাল আসছেনা। একটু পর দেখি এক দাদু টাইপ ভদ্রলোক বললো আমি তুলে দিব? আমি বললাম শিওর থ্যাংকইউ। সে বেশ কটা ছবি তুলে দিল। তারপর তাকে বললাম আমি তুলে দেই তোমার কয়টা। সে ফোন দিল তখন, তার সাথে তার পিচ্চি নাতি আছে তাকে কোলে নিয়ে ছবি তুললো।

তারপর বললো তুমি ইন্ডিয়ার? বললাম না বাংলাদেশ। সে বললো ও হ্যা বাংলাদেশ। জিজ্ঞেস করলাম চিন বাংলাদেশ কোথায়। বললো হ্যা ইন্ডিয়ার পাশে, আমি ইয়াং বয়সে ইন্ডিয়া ঘুরতে গেছিলাম তখন শুনেছি। তাকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার বাড়ি কোথায়? বললো আমি এখানেই থাকি মিউনিখে, আমার নাতিকে ক্যাসেল দেখাতে নিয়ে এসেছি৷ জার্মানদের সাথে যত পরিচয় হচ্ছে ফ্রেন্ডলি ই মনে হচ্ছে। এতদিস রুড রুড শুনে কোনভাবেই মিলাতে পারছিনা। কারো থেকে না শুনে নিজে এক্সপেরিয়েন্স করার পার্থক্য কি তা প্রতিদিন বুঝছি।

এরপর বেশকিছু ছবি তুলতে তুলতে আমার সময় হয়ে এল। চলে গেলাম মেইন গেট দিয়ে৷ ঠিক টাইম মত গেইটের সামনে দাড়িয়ে কিউআর কোড স্ক্যান করে অটোমেটিক দরজা দিয়ে ঢুকলাম। ভিতরে ঢোকার পর সবাইকে ওয়াকিটকি টাইপের একটা ডিভাইস দিল সেটা কানে লাগায়ে শুনতে হয়৷ কিভাবে ক্যাসেল হল আর রাজার লাইফস্টাইল এসব নিয়েই পুরো ট্যুর টা। ক্যাসেল টা রাজা কত শখ করে বানিয়েছিল তা প্রতিটা ইঞ্চি ইঞ্চি তে বোঝা যায়। একটার পর একটা ঘরে যাচ্ছি আর অবাক হচ্ছি। যথেষ্ট এডভান্স ক্যাসেল ছিল। সেন্ট্রাল হিটিং, রুমে রানিং ওয়াটার এসব সে সময় ভাবাই যেত না৷


ক্যাসেলের জানালা দিয়ে দেখা পিছনের ব্রিজ টা।

কিভাবে ৪৫ মিনিট শেষ হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। ফেরার সময় ক্যাসেলের জানালা থেকে বাভারিয়ান আল্পস চোখে পড়লো। একদিকে বিশাল সবুজ মাঠ তো আরেকদিকে বরফ আচ্ছাদিত পাহাড়। অথচ বেচারা রাজা বেশিদিন বাঁচেনি খুব অল্প বয়সে মারা গেছিল। দুনিয়ার বুকে স্বর্গ বানিয়ে উপভোগ করতে পারেনি বেশিদিন। মতান্তরে তাকে খুন করা হয় বলে অনেকে। তার এসব ওল্টাপাল্টা কাজ ই সেজন্য দায়ী। পাগল রাজা না হলে এত সুন্দর জিনিষ আজ আমরা উপহার পেতাম না হয়তো।

নিচে রাখা পুরো ক্যাসেলে মিনিচার ভার্সন

ট্যুর শেষে বেশ কিছুক্ষণ হাইক করে একটা ব্রিজে যেতে হয়। দুর থেকে পুরা ক্যাসেলের সুন্দর একটা ভিউ পেতে। গেইট হতে বের হয়ে গার্ড কে জিজ্ঞেস করলাম ব্রিজ টা কি এই রাস্তায়? সে বললো হ্যা। এরপর হাঁটা শুরু করলাম। ১৫-২০ মিনিট যেতে একটা ভিউ পয়েন্ট চোখে পড়লো।

ব্রীজে যাবার মাঝপথের ভিউ

এখানে এসে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এত সুন্দর জায়গা নিজের চোখে দেখছি তা বিশ্বাস করা যায় না আসলে। সামনে দুটো লেক তার পাশে গ্রাম আবার হোহেনশোয়ানগাও ক্যাসেল ও চোখে পড়ে। আর দুরে মেঘে ঢাকা বরফাচ্ছাদিত আল্পস। রুপকথার গল্পের মত লাগছে। এমন ছবি সুইজারল্যান্ডের দেখেছি অনেক। সুইজারল্যান্ড অবশ্য এখান থেকে বেশ কাছেই।

হোহেনশোয়ানগাও ক্যাসেল দেখা যায় সেই ভিউপয়েন্ট থেকে

বেশ কিছু ছবি তুলে আরো কিছুটা পথ হাইক করে গেলাম। দেখি একটা ঝুলন্ত ব্রিজ আর মানুষে ভরা পুরোটা। এমন অনেক ব্রিজে নেপালে চড়েছি তবে এটা বেশ উঁচুতে।তবে যাদের উচ্চতা ভিতি আছে তাদের না যাওয়াই উত্তম। আমার কাছে সবচে বেষ্ট ছিল এই ব্রীজ থেকে ভিউ টা। ব্রীজের একদিকে ক্যাসেল আরেকদিকে সবুজ পাহাড়। পাহাড় টা অনেকটা ছবির মত। যেন লাইভ ওয়ালপেপার দেখছি। একসময় কম্পিউটার স্ক্রিনের জন্য এমন ছবি ব্যবহার করতাম। এখন নিজে ক্যামেরা দিয়ে সে ছবি তুলছি।

ব্রীজের অপরপাশে ওয়ালপেপার মত সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ

কেউ পয়সা বাচাইতে চাইলে ক্যাসেলের ভিতরে যেতে নিষেধ করবো। ভিতরে আহামরি কিছু নেই। তবে এত কষ্ট করে গিয়ে ১৩ ইউরো খরচ বাচাতে ভিতরে না যাওয়া বোকামি। বীজ থেকে পুরো ক্যাসেল টা অন্যরকম লাগে দেখতে। ভাবছি ফল সিজনে গেলে কতই না সুন্দর লাগবে।

ক্যাসেলের সাথে আমি এবং অবশেষে ভাল একটা ছবি

বেশ অনেকক্ষণ কাটিয়ে বেশ ক’জন কে রিকুয়েস্ট করে ছবি তুললাম কয়েকটা। শেষমেষ দেখি আমার সেলফি ই ভাল এসেছে। এরপর নেমে যেতে শুরু করলাম। বেলা ৪ টা বাজতে চললো। ২০-২৫ মিনিট হেঁটে নেমে পড়লাম। বেশ ক্ষুধা পেয়েছে খাবার জন্য কিছু খুঁজতে হবে। জার্মানিতে একটা জিনিষ দেখলাম ট্যুরিস্ট স্পটে দাম আহামরি বেশি না। হয়তো ৮-১০ সেন্ট বেশি হবে। অনেক ক্ষেত্রেই সমান বলা যায়। জার্মানির খুব ফেমাস আরেকটা ফুড হল কারি উরস্ট ( উচ্চারন ঠিক কিনা জানিনা)। দেখি নিচের এক দোকানে সেল করছে। ভাবলাম ট্রাই দেই, এটা অনেকটা জার্মান ফাস্টফুড বলা যায়। কারি উরস্ট উইথ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। সসেজ এর উপর একধরনের গ্রেভি সাথে সস আর তারউপর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিল। একদম ফ্রেশ গরম গরম ভেজে দিল। সেখানে হালকা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে খাওয়া শুরু করলাম।

কারি উরস্ট উইথ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই

অনেকটা দেশি মানে ইন্ডিয়ান ফ্লেভার পেলাম মনে হচ্ছে। বেশ পছন্দ হয়েছে আমার ডিশ টা। খেয়ে রওনা দিলাম বাস স্টপে। ৫ মিনিট হাঁটলেই বাস স্টপ পড়ে। দেখি কম করে হলেও ৫০ জন অপেক্ষা করছে। প্রায় ৩০ মিনিট অপেক্ষা করার পর বাস আসলো। সবাই লাইন ধরে উঠে পড়লাম। এবারও আগের মতই মানুষজনকে ফলো করতে করতে মিউনিখের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মাঝে ট্রেন চেঞ্জ করতে হল এবার। ট্রেনে দেখি একজন বিশাল সাইজ কুকুর নিয়ে উঠলো। এখানকার কুকুর একেকটা দুই তিন ফিট উঁচু বলা যায়। মজার ব্যাপার হল এখানে ট্রেনে সাইকেল, কুকুর নেবার জন্য আলাদা টিকেট আছে। আবার নির্দিষ্ট ট্রেন বাস আছে যেগুলো এসব নেয়া যায়। সব ট্রান্সপোর্টে আবার এলাউড না। ৩ ঘন্টা পর মিউনিখে এসে পৌছুলাম। একটু সন্ধ্যা সন্ধ্যা হয়ে এসেছে যখন এসে পৌছুলাম। মিউনিখ গিয়ে এখানে না গেলে অনেক বড় আফসোস রয়ে যেত। সুপার ট্যুরিস্টি হলেও ওর্দি একটা জায়গা ছিল আমার কাছে। দিনশেষে তৃপ্তি নিয়ে ফিরেছি।

এসে সরাসরি রুমে গিয়ে হটশাওয়ার নিলাম এরপর বসে ফোন চার্জে দিলাম। একটু পর আমার পাশের বেডের জন এর সাথে কথা শুরু হল। জন আমেরিকা থেকে এসেছে, এখানে তার ট্রানজিট পড়েছে দিল্লি যাবার জন্য। সে অনেকটা অনির্দিষ্টকালের জন্য ইন্ডিয়া ঘুরতে যাচ্ছে। সাধারণত আমেরিকান রা ঘুরে না এমন। তাই তাকে প্রশ্ন করলাম হটাৎ এমনভাবে ঘুরছো। তারপর সে সব গল্প বললো।

বাম থেকে আমি, মেরিনা, বেন, জন আর ম্যাট

এর একটু পর বেন, ম্যাট আর মেরিনা আসলো। মেরিনা হলো বেয়ার্ন মিউনিখের পাগলা ফ্যান। তার মিউনিখ আসার একটাই কারণ হইলো আলিয়ান্জ এরিনা দেখা, বেয়ার্ন মিউনিখের বার্থ প্লেস। আর গত সপ্তাহে নাকি বুন্দেসলিগা জিতলো তাই আরো যাবে সে। সবাই ঠিক হল যাবে স্টেডিয়াম দেখতে।

আমি ভাবলাম এই প্যানপেনে বৃষ্টিতে বসে থেকে কি করবো যাই ঘুরে আসি৷ বললাম ক্যান আই জয়েন ইউ গাইস? এরপর তাদের সাথে রওনা দিলাম। আজকে সারাদিন টানা বৃষ্টি হয়েছে এখনো চলছে৷ বের হলাম ট্রেন স্টেশনে গিয়ে টিকেট কেটে রওনা দিলাম৷ স্টেশনের নামের পাশে ফুটবলের ইমোজি দেয়া। স্টেশনে আমরা ছাড়া কেউ নাই। গেলাম প্রায় ১৫ মিনিট হেঁটে একদম স্টেডিয়ামের পাশে।

আমরা সবাই আলিয়ানজ এরিনার সামনে

ভাইরে ভাই এটা জিনিষ একটা। একটু পর পর কালার বদলায়। সামনে থেকে না দেখলে বোঝা যাবেনা। অসাধারণ এক কথায়। সাথে বৃষ্টি মনে হচ্ছে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আজকের এই ঝটিকা ট্রিপ স্মরনীয় হয়ে থাকবে। একদল র‌্যান্ডম মানুষজন একসাথে বেয়ার্ন মিউনিখের স্টেডিয়াম দেখতে যাওয়া। তিনজন নর্থ আমেরিকা একজন মেরিনা সাউথ আমেরিকান।

ফাঁকা ট্রেনে আমাদের পাগলামি

ফেরার সময় দেখি পুরা ট্রেন ফাঁকা আমরা ছাড়া কেউ নাই। এরপর আমরা সবাই মিলে ক্রেজি স্টাইলে বেশকিছু ছবি তুললাম। ট্রিপের সবচে পছন্দের ছবি সেটাই ছিল। কয়েকঘন্টার পরচিয়ে সবাই বেশ ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম। রাত ১২ টা বাজে পৌছুলাম হোস্টেলে। বৃষ্টি এখনো সেভাবেই চলছে। গেলাম পাশের এক টার্কিশ রেস্টুরেন্টে৷ ডিনার করে ফিরে এসে ঘুম। পরদিন রওনা দিব ভিয়েনার উদ্দেশ্যে।

 

Facebook Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *