অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প ট্রেক দ্বিতীয় দিন

অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প ট্রেক দ্বিতীয় দিন

Sharing is caring!

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮
তিহকেডাঙা থেকে গোরেপানি যাবার রাস্তা।


একদম ঝর্নার উপর লজে ছিলাম, সারারাত পানি পড়ার শব্দ অনেকটা বাইরে ঝুম বৃষ্টি হবার মত ছিল। খুব কষ্ট হয়নি প্রথম দিন, পাহাড় চড়া তেমন ছিল না। খুব ফুরফুরা ছিলাম, বসে হিমশীতল বাতাস গেলা আর গান শুনে অনেকক্ষন কাটিয়ে দিলাম। তারপর আড্ডা দিলাম টুকটাক এর মধ্যেই ডিনার চলে আসলো।


সকালে ঘুম থেকে উঠে বেশ লাগছিল, গেলাম ঝর্না টা কে আরেকটু কাছ থেকে দেখার জন্য। দেখি সবাই নিচে বসে আছে অলরেডি। ক্যামেরা টা নিয়ে গেলাম টুকটাক ছবি তুলতে। সবার ফটোশেসন শুরু হল। এর মধ্যে ক্রিস্টেন তার ছবি তুলে দেবার জন্য জেনেসা কে ফোন দিল। জেনেসা ২-৩ টা ছবি তুললো ঠিকঠাক এরপর পারফেক্ট শট নিতে গিয়ে জেনেসা স্লিপ করে ফোন পানিতে ফেলে দিল, আর পানির প্রচন্ড প্রেসারে ফোন তো আর থাকেনা৷ যদিও ক্রিস্টেন শেষ মুহূর্তে ফোন টা হাতে ধরতে পেরেছিল কিন্তু পানির কারণে পারেনি। এদিকে আমি তার হাত শক্ত করে ধরে টান দিলাম। আর একটু হলে একটা ডেডবডি নিয়ে ফিরে যেতে হত। ফোনে অনেক কিছু থাকে মানুষের কিন্তু কখনোই জিবনের থেকে মুল্যবান হতে পারেনা, কিন্তু সেসব সময়ে সবার হিতাহিতজ্ঞান শুন্য হয়ে যায়। প্রকৃতি সুন্দর হলেও একটু অসাবধানতার জন্য মৃত্যু অবধারিত।


যাইহোক সকাল টা নষ্ট হয়ে গেল। আপার আইফোন গেসে তার থেকে বড় জিনিষ হল ক্রেডিট কার্ড। যদিও তারকাছে যথেষ্ট ক্যাশ ছিল। বাঙালি হইলে সকাল সকাল একটু চুলাচুলি দেখার সৌভাগ্য হইতো। আফটারঅল আইফোন ফালায় দিসে পানিতে। এরপর একটু ব্যার্থ চেষ্ট চললো ফোন খোঁজার। ঝর্নার পানির যে তেজ তাতে ফোন পাওয়া গেলেও ১০ টুকরা হয়ে যাবার কথা। যাইহোক পরে কোনরকম সবাই নাস্তা করলো। এরপর রওনা দিলাম।


ক্রিস্টেন শুরু থেকেই চুপচাপ ছিল , আর জেনেসা সবসময় হাসতে হাসতে কথা বলতে থাকা একটা মেয়ে। গতদিনের পুরা হাইকিং এ তার সাথে আড্ডা দিতে দিতে এসেছি। আজ ফোন ফেলে দিয়ে সে অনেকটা গিলটি ফিল থেকে চুপচাপ। পুরা টিম টা সাইলেন্ট হয়ে গেল অনেকটা।


সকাল ৯ টার দিকে শুরু করলাম হাঁটা। শুনেছিলাম এবিসি ট্রেকে একদিন অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়৷ জানতাম না সেই দিন টা আজকেই। শুরু করলাম সিঁড়ি বেয়ে উঠা। সেই ইনফিনিটি সিঁড়ি শেষ হইতেই চায় না। পরে জেনেছিলাম ৩২০০ মত সিঁড়ি আছে সেখানে। ৩ ঘন্টা মত শুধু সিঁড়ি বেয়ে উঠেছি। এরপর পেয়েছি কিছুটা সমতল কিছুটা উঠা।


তবে কষ্ট স্বার্থক মনে হয়েছে এরপর। হুট করেই ঢুকে গেলাম মেঘের মধ্যে। প্রথমে মনে হল কুয়াশা, কিসের কুয়াশা রিতিমত সাদা মেঘ। আশেপাশের লজগুলো কেমন যেন রাজপ্রাসাদের মত মনে হতে লাগলো৷ মাঝে মাঝে ১০ হাত দুরের কিছু দেখা যায় না৷ এজন্য হটাৎ করে অন্য দুনিয়ায় চলে এলাম আমি। নির্জন রাস্তা গুলোয় কেমন যেন ছমছমে ভাব।


রুপকথার গল্পের মত হুট করে দৈত্য পরী বের হয়ে আসলে অবাক হতাম না একটুও। এমন মেঘে ঢাকা রাস্তায় ঘোড়াগুলো দেখে মনে হল, এই ঘোড়াগুলি উড়তে জানে৷ পুরোটা সময় মুখে অন্যরকম হাসি লেগে ছিল। আমি সাধারণত হাঁটার সময় কানে ইয়ারফোন গুঁজে হাটি৷ এবারের ট্রেকে সেটা হয়নি।


ঘন্টার পর ঘন্টা হেঁটে চলেছি, একটুও বিরক্ত লাগছে না। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। মাঝে মাঝে এমন নিস্তব্ধতা অনেক জরুরি। মাঝে মাঝে দাড়িয়ে একবার চারপাশ টা চোখ দিয়ে গিলে নিচ্ছি। এই সৌন্দর্য্য যে কোনদিন ক্যামেরাতে ধরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।


গোরেপানি পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। ১০০০ মিটারের বেশি এলিভেশন গেইন করেছি সেদিন। হাঁটুর রিতিমত বারোটা বাজায়ে ফেলেছি। বলা যায় বুর্জ খলিফার নিচ থেকে টপ ফ্লোরের চেয়ে উঁচুতে সিড়ি বেয়ে উঠেছি। ৬ ঘন্টার কন্টিনুয়াস পাহাড় বেয়ে উপরে উঠা, তারউপর ঘাড়ে ১২ কেজির ব্যাকপ্যাক।


গোরেপানির সবচেয়ে সুন্দর লজ টা কিভাবে চলে গেলাম। ঢোকার রাস্তায় সুন্দর ফুল দিয়ে ঘেরা৷ রুমে ঢুকেই অবাক, জানালা দিয়ে দেখাযাচ্ছে সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়চুড়া। সারাদিন ঘরে বসে সময় কাটিয়ে দেয়া যায়। গোরেপানি পুরা ট্রেকের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ছিল আমার কাছে।


লজের নিচে বসার জায়গাটাও বেশ। ভিতরে ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে পুরো ক্লান্তি চলে গেল। সে আড্ডায় পরিচয় হল কোরিয়ান এক ছেলের সাথে। তার নাম জেইমি, জেইমির কাছ থেকে জানলাম কোরিয়ানদের বয়স কাউন্ট করার অদ্ভুত নিয়ম। কোরিয়ানরা বয়স কাউন্ট করে মায়ের পেটে থাকার সময় থেকেই৷ জেইমি কে নিয়ে আলাদা লিখবো একদিন। জমিয়ে আড্ডা হল সেদিন,যদিও সকালের ফোন হারানোর ঘটনাটা সবকিছু ডাউন করে দিয়েছিল৷ তারপরেও বেশ মজা করেছি, এত অদ্ভুত সুন্দর জায়গাতে আসলে মন খারাপ করে কেউ থাকতেই পারবেনা।


পরদিন ভোরে উঠে যেতে হবে পুনহিলে সূর্যোদয় দেখতে৷ তাই বেশি রাত না করে ঘুমি পড়লাম। পরদিন প্রায় ৭-৮ ঘন্টা হেঁটে তাদাপানি যেতে হবে৷ পায়ের যা অবস্থা পরদিন কি করবো ভেবে একটু চিন্তিত ছিলাম।

Facebook Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *