অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প ট্রেক তৃতীয় দিন

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮
গোরেপানি থেকে তাদাপানি
আগেরদিন প্রায় ৬ ঘন্ট হেঁটে পায়ের বারোটা বেজেছে। প্রতিদিন প্রচুর এনার্জি বার্ন করছি, সে হিসাবে খাওয়া হচ্ছে না। তাই রাতে ডিনারে অর্ডার দিলার স্প্যাগেটি উইথ চিজ। জিনিষটা এভারেজ ছিল তবে না খেলে পরদিন হাঁটতে পারবোনা বলে গিলেছি। আড্ডাবাজী করে রাতে ঘুমাতে গেলাম ভোরে উঠে পুনহিল ট্রেক করে যেতে হবে সুর্যোদয় দেখতে।
ভোর ঠিক ৪ টা সময় ঘুম থেকে উঠলাম। বাইরে একদম অন্ধকার না। রুমের জানালা দিয়ে বাইরে সাদা পাহাড়ের চুড়া দেখা যাচ্ছে। এমন সকাল রোজ হয়না, সবকিছু কেন যেন স্বপ্নের মত লাগছে। পুরোটা সময় একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমি ক্রিস্টেন আর জেনেসা একসাথে বেরুলাম। বাইরে চাদের আলোতে আবছা সবকিছু দেখা যাচ্ছে। প্রচন্ড ঠান্ডা বাইরে ২-৩ ডিগ্রি হবে মনে হয়।
পুনহিল জায়গাটা গোরেপানি থেকে অনেক উপরে। কিন্তু আমরা নিচে নামতেই আছি, আধাঘন্টা হাঁটার পর কি মনে করে ম্যাপ ওপেন করে দেখি আমরা একদম উল্টো দিকে গেছি। এখন আবার ৩০ মিনিট উঠে আবার ৪৫ মিনিট মত উপরে উঠতে হবে৷ মানে পুরা একঘন্টা ভুল পথে। আজকেও আগের দিনের মত ৫-৬ ঘন্টা হেঁটে তাদাপানি যেতে হবে৷ আমি গোরেপানিতে উঠে আর গেলাম না পুনহিল। আমি তখন যথেষ্ট ক্লান্ত আর আগের দিন ৩০০০ সিঁড়ি বেয়ে হাঁটুর অবস্থা বিশেষ ভাল না।
ঠিক করলাম রুমে বসেই সূর্যোদয় দেখবো আর নাস্তা করবো। রুমে গিয়ে দিব্যি ঘন্টাখানেক ঘুম দিলাম তারপর উঠে টিবেটিয়ান ব্রেড অর্ডার করে আসলাম। সাথে এক কাপ চা নিয়ে বসে জানালা দিয়ে সূর্যোদয় দেখে ফেললাম। পরে পুনহিলের ছবি দেখে আফসোস হয়নি। এরপর সবাই নাস্তা শেষে রওনা দিলাম তাদাপানির উদ্দেশ্য।
রওনা দিয়েই শুরুতে একটা চাইনিজ কাপলের সাথে দেখা। তারা ৫/৬ বছরের পিচ্চি বাচ্চাকে নিয়ে ট্রেকে এসেছে! ইনসেইন পুরা! তবে যাত্রার শুরুতে এমন কিছু দেখে নিজের আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে গেল। ৫ বছরের বাচ্চা যদি পারে আমি কেন পারবোনা। হাঁটুতে ব্যাথা নিয়েই শুরু করলাম।
একটু পর দেখা মিললো এক ঝাঁক ঘোড়ার। আগের গরু ছাগলের পাল দেখেছি, প্রথমবারের মত ঘোড়ার পাল দেখলাম। প্রতিটা ঘোড়ার গলায় ঝুনঝুনি লাগানো। হাঁটলেই অদ্ভুত সুন্দর শব্দ হচ্ছে, পুরো পরিবেশটা কেমন জানি ঘোর লাগানো।
এরপর রীতিমত জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা, তারপর হুট করেই চলে আসলাম মেঘের উপরে। শুধু উঁচু পাহাড়ের চুড়া গুলো দেখা যাচ্ছে আর মাঝখানের ফাঁকা জায়গাতে মেঘে ভেসে বেড়াচ্ছে। আবার কিছুটা জঙ্গল, বিশাল লম্বা লম্বা গাছ। হুট করে মনে হল আমাজনের কোন জঙ্গলে বা বিয়ার গ্রিলসের শো স্বশরীরে উপভোগ করছি। এর মধ্যেই দেখা মিললো পিচ্চি ঘোড়ার শাবক।
পাহাড়ি ফুল, ঝর্না, ঝিরি পুরোটা ছবি তে তুলে আনা সম্ভব নয়। ছবির মত সুন্দর গ্রাম, বাড়িঘর৷ সবকিছু কেমন জানি পারফেক্টলি সাজানো৷
ভেবেছিলাম এই ট্রেক শুধু যুবকদের জন্যু। সেদিন ভুল টা ভেঙেছিল, ট্রেইলে আমি ৬০ বছরের কাপল থেকে শুরু করে ৮-১০ বছরের বাচ্চা দেখেছি৷ আমাদের দেশের বাবা মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে এমন জায়গাতে যাবার কথা হয়তো ভাবতেই পারবেনা।
প্রায় ৫/৬ ঘন্টা হেঁটে চলে আসলাম তাদাপানিতে। তাদাপানি অনেকটা নিচে গোরেপানি থেকে তাই বেশি কষ্ট হয়নি, তবে হাঁটুর উপর প্রচুর প্রেসার পড়েছে৷ পেইনকিলারের উপর আছি গত দুদিন।
তাদাপানি জায়গাটা অনেক নিচে হলেও পুরো গ্রামটা মেঘে ঢাকা। লজের জানালা দিয়ে বাইরে দেখার সুযোগ ছিল না। তবে লজের পাশে একটা বসার জায়গা আছে যেখানে বসে অন্নপূর্ণা সাউথ, হিনচুলি ফিসটেইল এর চুড়া দেখতে দেখতে চা খাওয়া যায়। সকালে উঠে সেখানেই বসে নাস্তা করলাম। গায়ে মিষ্টি রোদ এসে লাগছে আর নাস্তা করতে করতে সাদা পাহাড় দেখা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
পরদিন যেতে হবে চমরং, এখন শুধু উপরে উঠা।